3.6.1 রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল:
1911 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন সম্পর্কে একটি মডেল প্রদান করেন। মডেলটি এরকম:
(a) পরমাণুর একটি কেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্রের নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটন এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রন অবস্থান করে। যেহেতু আপেক্ষিকভাবে ইলেকট্রনের ভর শূন্য ধরা হয় কাজেই নিউক্লিয়াসের ভেতরে অবস্থিত প্রোটন এবং নিউট্রনের ভরই পরমাণুর ভর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(b) নিউক্লিয়াস অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং পরমাণুর ভেতরে বেশির ভাগ জায়গাই ফাঁকা
(c) সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষপথে যেমন গ্রহগুলো ঘুরে তেমনি নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষপথে ইলেকট্রনগুলো ঘুরছে। কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে কয়টি প্রোটন থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে সেই কয়টি ইলেকট্রন থাকে। যেহেতু প্রোটন এবং ইলেকট্রনের চার্জ একে অপরের সমান ও বিপরীত চিহ্নের, তাই পরমাণুর সামগ্রিকভাবে চার্জ শূন্য।
চিত্র 3.01: রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল।
(d) ধনাত্মক চার্জবাহী নিউক্লিয়াসের প্রতি ঋণাত্মক চার্জবাহী ইলেকট্রন এক ধরনের আকর্ষণ বল অনুভব করে। এই আকর্ষণ বল কেন্দ্রমুখী এবং এই কেন্দ্রমুখী বলের কারণে পৃথিবী যেরকম সূর্যের চারদিকে ঘুরে ইলেকট্রন সেরকম নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরে। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলকে সৌরজগতের সাথে তুলনা করা হয়েছে বলে এ মডেলটিকে সোলার সিস্টেম মডেল বা সৌর মডেল বলে। আবার, এ মডেলের মাধ্যমে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াস সম্পর্কে ধারণা দেন বলে এ মডেলটিকে নিউক্লিয়ার মডেলও বলা হয়।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতা:
রাদারফোর্ডই সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের কক্ষপথ সম্বন্ধে ধারণা দেন। তিনিই সর্বপ্রথম একটি গ্রহণযোগ্য পরমাণু মডেল প্রদান করলেও তার পরমাণু মডেলের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সেগুলো হলো:
(a) এই মডেল ইলেকট্রনের কক্ষপথের আকার (ব্যাসার্ধ) ও আকৃতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা দিতে পারেনি।
(b) সৌরজগতের সুর্য ও গ্রহগুলোর সামগ্রিকভাবে কোনো আধান বা চার্জ নেই কিন্তু পরমাণুতে ইলেকট্রন এবং নিউক্লিয়াসের আধান বা চার্জ আছে। কাজেই চার্জহীন সূর্য এবং গ্রহগুলোর সাথে চার্যযুক্ত নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের তুলনা করা হয়েছে। কাজেই চার্জহীন বস্তুর সাথে চার্জযুক্ত বস্তুর তুলনা সঠিক নয়।
(c) একের অধিক ইলেকট্রনবিশিষ্ট পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো কীভাবে নিউক্লিয়াসের চারদিকে পরিভ্রমণ করছে তার কোনো ধারণা এ মডেলে দেওয়া হয়নি।
চিত্র 3.02: ইলেকট্রন শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হচ্ছে।
(d) ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বানুসারে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনের সময় ক্রমাগত শক্তি হারাতে থাকবে। ফলে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন পথও ছোট হতে থাকবে এবং এক সময় সেটি নিউক্লিয়াসের উপর পতিত হবে। অর্থাৎ পরমাণুর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে বা পরমাণু স্থায়ী হবে না। কিন্তু প্রকৃতিতে সেটা ঘটে না অর্থাৎ ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বানুসারে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল সঠিক নয়।
3.6.2 বোর পরমাণু মডেল:
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটিগুলোকে সংশোধন করে 1913 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী নীলস্ বোর পরমাণুর একটি মডেল প্রদান করেন। এই মডেলকে বোরের পরমাণু মডেল বলা হয়। বোর পরমাণু মডেলের মতবাদগুলো এরকম—
(a) পরমাণুতে যে সকল ইলেকট্রন থাকে সেগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইচ্ছামতো যেকোনো কক্ষপথে ঘুরতে পারে না। শুধু নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কতগুলো অনুমোদিত বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে। এই নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের অনুমোদিত বৃত্তাকার কক্ষপথগুলোকে অনুমোদিত কক্ষপথ বা প্রধান শক্তিস্তর বা কক্ষপথ বা শেল বা অরবিট বা স্থির কক্ষপথ বলে। স্থির কক্ষপথে ঘুরার সময় ইলেকট্রনগুলো কোনোরূপ শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে না। স্থির কক্ষপথকে 11. দ্বারা প্রকাশ করা হয়। n = 1, 2, 3, 4 ইত্যাদি। অন্যভাবে বলা যায়, 11 = 1 হলে K প্রধান শক্তিস্তর, 11 = 2 হলে L প্রধান শক্তিস্তর, n = 3 হলে M প্রধান শক্তিস্তর, n = 4 হলে N প্রধান শক্তিস্তর ইত্যাদি।
(b) বোর মডেল অনুসারে কোনো শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ mvr =
m হচ্ছে ইলেকট্রনের ভর (9.11× kg)
r হচ্ছে ইলেকট্রন যে কক্ষপথ বা শক্তিস্তরে ঘুরবে তার ব্যাসার্ধ r
v হচ্ছে ইলেকট্রন যে কক্ষপথ বা শক্তিস্তরে ঘুরবে সেই কক্ষপথে ইলেকট্রনের বেগ v
h হচ্ছে প্লাঙ্ক ধ্রুবক ( h = 6.626 x m2 kg/s )
n হচ্ছে প্রধান শক্তিস্তর বা প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n = 1, 2, 3 ........ ইত্যাদি।)
এখানে যে শক্তিস্তরের এর মান কম সেই শক্তিস্তর নিম্ন শক্তিস্তর এবং যে শক্তিস্তরের এ এর মান n বেশি সেই শক্তিস্তর উচ্চ শক্তিস্তর হিসেবে পরিচিত।
চিত্র 3.03: বোরের পরমাণু মডেল।
(c) কোনো প্রধান শক্তিস্তরে ইলেকট্রন ঘুরার সময় ইলেকট্রনের কোনো শক্তি শোষিত বা বিকিরিত হয় না, ভৰে ইলেকট্রন যদি নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তর এ যায় তখন শক্তি শোষিত হয়। আবার, যদি ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তর এ যায় তখন শক্তি বিকিরিত হয়। এই শোষিত বা বিকিরিত শক্তির পরিমাণ hv=
C হচ্ছে আলোর বেগ ( 3 x ms-2 )
v হচ্ছে শোষিত বা বিকিরিত শক্তির কম্পাঙ্ক (একক বা Hz)
হচ্ছে শোষিত বা বিকিরিত শক্তির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য (একক m)
ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে যাবার সময় যে আলো বিকিরণ করে তাকে প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করালে পারমাণবিক বর্ণালি (atomic spectra) সৃষ্টি হয়।
বোরের পরমাণু মডেলের সাফল্য:
(a) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ-উপগ্রহগুলো যেমন ঘুরছে, পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলোও তেমন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এখানে ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের আকার সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি কিন্তু বোরের পারমাণবিক মডেলে পরমাণুর শক্তিস্তরের আকার বৃত্তাকার বলা হয়েছে।
(b) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে পরমাণু শক্তি শোষণ করলে বা শক্তি বিকিরণ করলে পরমাণুর গঠনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে সে কথা বলা হয়নি কিন্তু বোর পরমাণু মডেলে বলা হয়েছে পরমাণু শক্তি শোষণ করলে ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে ওঠে। আবার, পরমাণু শক্তি বিকিরণ করলে ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে নেমে আসে।
(c) রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে কোনো মৌলের পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যা করা যায় না কিন্তু বোরের পরমাণু মডেল অনুসারে এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণু হাইড্রোজেন (H) এর বর্ণালি ব্যাখ্যা করা যায়।
বোরের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতা:
বোর মডেলেরও কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। সেগুলো হচ্ছে:
(a) বোর মডেলের সাহায্যে এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যা করা যায় সত্যি কিন্তু একাধিক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যা করা যায় না।
(b) বোরের পারমাণবিক মডেল অনুসারে এক শক্তিস্তর থেকে ইলেকট্রন অন্য শক্তিস্তরে গমন করলে পারমাণবিক বর্ণালিতে একটিমাত্র রেখা পাবার কথা। কিন্তু শক্তিশালী যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায় প্রতিটি রেখা অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখার সমষ্টি। প্রতিটি রেখা কেন অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখার সমষ্টি হয় বোর মতবাদ অনুসারে তার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।
(c) বোরের পরমাণুর মডেল অনুসারে পরমাণুতে শুধু বৃত্তাকার কক্ষপথ বিদ্যমান। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছে পরমাণুতে ইলেকট্রন শুধু বৃত্তাকার কক্ষপথেই নয় উপবৃত্তাকার কক্ষপথেও ঘুরে।
আরও দেখুন...